একটি মৃত্যু : কিছু জরুরী ভাবনা

গত ২১ ডিসেম্বর ২০১২ রোজ জুমাবার জুমার আজানের সময় আমার শ্বশুর ইন্তেকাল করেন। তিনি আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। (তাঁর ভাষায়) ‘আলেম’ (আসলে তালিবুল ইলম) জামাই পেয়ে তাঁর তৃপ্তি ও গর্বের অন্ত ছিল না। পুত্রবৎ জামাই তাঁর জানাযার সালাত পড়াবে বলে তিনি কতবারই না আগাম তৃপ্তি ও মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন। নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছেন। সাতদিন আগে মৃত্যুশয্যা ও বাকরুদ্ধ হবার বার্তা শুনে তাঁর মেয়েসহ ছুটে এলাম। শিয়রে দাঁড়াতেই বোবা কান্নায় চোখ ভেসে দিলেন। মৃত্যুকালে যদি তাঁর পাশে না থাকতে পারি সে শংকায় তিনবার প্রস্তুতি নিয়েও ঢাকায় যাই নি। কেন জানি মন টানছিল না। মনে হচ্ছিল আমি যাওয়া মাত্র যদি তিনি চলে যান। স্নেহের ‘পুত্র’কে ডেকে কাছে না পান। মাওলানা লাবীব আব্দুল্লাহ ভাইয়ের মতো নেককার মানুষের পর আমার মনও বলছিল আমাদের নির্বিবাদী অতি সাদাসিধে মুরব্বী হয়তো জুমাবারেই দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবেন।

তারপর এলো সেই জুমাবার। আলালপুরের সফল ব্যবসায়ী মাওলানা এবং হবু ড. (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল করছেন) মোস্তফা ভাইয়ের বহুল উচ্চারিত দাবি, ‘শুক্রবার আপনি ময়মনসিংহে থাকলে অবশ্যই জুমা পড়াতে হবে আমাদের মসজিদে’। তাঁর দাবি আর লাবীব আব্দুল্লাহ ভাইয়ের পীড়াপীড়িতে সেখানেই জুমা পড়ার সিদ্ধান্ত হলো। আমার লাবীব ভাইয়ের সহযাত্রী হবার বার্তা পেয়ে আরও কয়েকজন সুহৃদ ও বন্ধু মাওলানা আমাদের সঙ্গী হলেন। গোসল সেরে দৌড়ে বের হলাম জুমা পড়াবার তাগিদে। গেট পেরিয়ে রাস্তামুখো হতে কেন যেন মন পেছনে টান দিল। বাসায় ফিরে এসে তাঁর চন্দ্রানন মুখে হাত বুলিয়ে বললাম, আব্বা, আপনি কী বলছেন? অস্ফূট স্বরে বললেন, ‘আল্লাহ’। ‘আপনি এটাই বলতে থাকেন আমি নামাজ পড়ে আসি বলে বেরিয়ে গেলাম’। মসজিদে গিয়ে যখন মিম্বারে বসতে যাচ্ছি তখনই ফোনটা কেঁপে উঠল। রিসিভ করার আগেই বুঝলাম কী হয়েছে! সমবেত মুসল্লির বিস্ফোরিত দৃষ্টির সামনে আমাকে পড়তে হলো, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজীঊন’। সেদিনের জুমার ভাষণে আমার আলোচনার বিষয় ছিল, ‘ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা’। মুহূর্তেই তা বদলে হয়ে গেল, ‘মৃত্যু : সকল প্রাণীর অপরিহার্য পরিণতি’।

বাদ মাগরিব নামাজে জানাযা হলো। মৃত্যুর দিন জুমাবার এবং জানাযায় মুসল্লির সংখ্যা দেখে বেদনার মধ্যেও সুখ অনুভব করলাম। মরহুমের প্রত্যাশা মতো নামাজ পড়ানোর সৌভাগ্যের জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম। বাসার সবাইকে শোক-কান্না ভুলে তাঁর জন্য দো‘আ করতে বলা হলো। কবরস্থ করা থেকে নিয়ে এখানে কাটানো বাকি দিনগুলোয় স্থানীয় অনেক কুসংস্কার ও কুপ্রথা দেখলাম। সাধ্যমত সংশোধন ও প্রতিহত করার চেষ্টা করলাম। তথ্যপ্রযুক্তির এই চরমোৎকর্ষের যুগেও মানুষ যে ধর্মীয় নিরেট জ্ঞান থেকে এত দূরে তা ভেবে যুগপৎ বেদনা এবং দাওয়াতী কাজ এবং লেখালেখিতে সক্রিয় হবার আরও প্রেরণা বোধ করলাম।

মৃত্যুর দ্বিতীয় দিন বাদ মাগরিব গেলাম শ্যালককে নিয়ে কবরস্থানে। শীতের তীব্রতায় সারাদেশ যখন জবুথবু, আমাদের মতো কর্মচঞ্চল জোয়ানরাও যখন বাধ্য হয়ে ঘরমুখো, তখন অশীতিপর শ্বশুরকে এই নিঃসঙ্গ কবরে শোয়ানোর সদ্যস্মৃতি ভাবনার জগতে ঝড় তুলল। ব্রহ্মপুত্র নদীঘেঁষা কবরস্থানে ঢুকে প্রথমে দেখলাম কেউ নেই। বুকের ভেতর কেমন মোচড় দিয়ে উঠল। কুয়াশাচ্ছন্ন কবরের কাছে গিয়ে যখন সুন্নাত মোতাবেক কাজ সারছিলাম, তখন নদীর শীতল জলচুম্বন করা বাতাস যেন শরীরে সুইয়ের মতো বিঁধতে লাগলো। অথচ হায়, এখানেই তো চব্বিশ ঘন্টা আগে আমাদের পরম প্রিয় শ্বশুরকে মাটির কাঁচা কবরে রেখে গেলাম। অবধারিত ওই সাদা পোশাক ছাড়া তাকে শীতবস্ত্র দেবার কোনো সুযোগ ছিল না সন্তানদের। যারা গতকালও তাঁর সুখের জন্য মুহূর্তে পানির মতো টাকা ঢেলেছে, মাটি বিছিয়ে একে একে তারা সবাই বিদায় নিয়েছে।

আমার নাতিদীর্ঘ জীবনে নিকটাত্মীয় কাউকে কবরে শোয়ানোর সুযোগ ঘটে নি। শ্বশুরকে কবরে শোয়াতে গিয়ে বুঝলাম এ কেমন নিঠুর সত্য। আজ আবার এ সত্যের মুখোমুখী হয়ে স্থির থাকতে পারলাম না। গতকাল লাশ দেখে সবার কান্নার স্রোতের বিপরীতে যেখানে কর্তব্যে অটল ছিলাম। আজ এ শীতার্ত সন্ধ্যায় কবরের কাছে সেই সংযমের যেন বাঁধ ভেঙ্গে গেল। শিকড় সাহিত্য মাহফিলের অফিসে প্রাণবন্ত সাহিত্য আড্ডার লোভনীয় হাতছানিতেও সাড়া দিতে পারলাম না। রাতে শোবার আগ পর্যন্ত চোখের অবিরল ধারা অবিরলই থাকল। কেবল স্ত্রীর কাছেই ব্যক্ত করলাম এ বাঁধহীন কান্নার আসল কারণ।

পবিত্র কুরআনে কতবার পড়লাম,

﴿كُلُّ نَفۡسٖ ذَآئِقَةُ ٱلۡمَوۡتِۗ وَنَبۡلُوكُم بِٱلشَّرِّ وَٱلۡخَيۡرِ فِتۡنَةٗۖ وَإِلَيۡنَا تُرۡجَعُونَ ٣٥﴾ [الانبياء: ٣٥]

‘প্রতিটি প্রাণ মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে; আর ভাল ও মন্দ দ্বারা আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করে থাকি এবং আমার কাছেই তোমাদেরকে ফিরে আসতে হবে।’ {সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত : ৩৫} -এর মতো কুরআনের অমীয় বাণী কতবার পড়েছি।

আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«أَكْثِرُوا ذِكْرَ هَاذِمِ اللَّذَّاتِ»

‘তোমরা সকল স্বাদের বিনাশকারী মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করো।’ [তিরমিযী : ২৩০৭; নাসাঈ : ১৮২৪]

এমন বাণীও পড়েছি বহুবার। কতবার মানুষের কাছে মৃত্যুর বাস্তবতা ও প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করেছি, লিখেছি একাধিক লেখা, একবার মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরেও এসেছি; কিন্তু আজ যেভাবে মৃত্যুকে অনুভব করলাম, কবরের এই নিঃসঙ্গ দৃশ্য যেভাবে চিন্তার জগতে সাইমুমের সূচনা করলো, তা আগে হয় নি। শুনেছি ও পড়েছি- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় জামাতা তৃতীয় খলীফা ‘উসমান ইবন আফফান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যখন কোনো কবরের পাশ দিয়ে যেতেন, তিনি এত বেশি কাঁদতেন যে তাঁর গণ্ড ও শ্মশ্রু বেয়ে বিপুল ধারায় অশ্রু নেমে আসত। আজ সম্যক উপলব্ধি হলো, কেন তিনি এভাবে কাঁদতেন। কেন তিনি এত অশ্রুপাত করতেন।

বড় আজব ব্যাপার হলো, আর সবার মতো আমিও হয়তো কদিন পর ভুলে যাব এসব অনুভূতির কথা! আবারও আমার কাছে এক সময় পার্থিব জীবন ও জগত বড় হয়ে উঠবে! নশ্বর জীবনের মোহে আবারও হয়তো পাপের সংস্পর্শে চলে যাব। মুক্ত থাকতে পারব না গুনাহের ছোবল থেকে।

পাকিস্তানের সাবেক বিচারপতি ও প্রখ্যাত আলেমে দীন মাওলানা তাকী উসমানী বলেছেন, মানুষ এ যাবত অনেক কিছু অস্বীকার করেছে। জন্মদাতা পিতামাতাকে অস্বীকার করেছে। পিতৃতুল্য শিক্ষককে অস্বীকার করেছে। পৃথিবীর বহু উপকারীর উপকার অস্বীকার করেছে। এমনকি খোদ তার স্রষ্টা আল্লাহকে অস্বীকার করেছে; কিন্তু মৃত্যুকে কেউ অস্বীকার করে নি। মৃত্যুকে অস্বীকারের মতো মূঢ়তা কেউ দেখায় নি কোনোদিন। পাঁড় নাস্তিকও এ জায়গায় আস্তিকের সমান্তরাল ভাবনায় উপনীত। কিন্তু হায়, এ মৃত্যুকেই কিনা আমরা ভুলে থাকি! হাজার মৃত্যু দেখে, প্রিয় স্বজনকে নিজ হাতে কবরে নামিয়েও আমাদের মৃত্যুর চেতনা জাগ্রত হয় না। শাশ্বত মৃত্যুর চেয়ে কিনা বড় হয়ে ওঠে আমাদের ক্ষণস্থায়ী জীবন-সংসার!

বলতে দ্বিধা নেই মুহুর্মুহু মৃত্যুর স্মরণ আর মৃত্যুর তেতো বাস্তবতার নিত্যনতুন উপলব্ধিই পারে আমাদের গুনাহের স্পর্শ থেকে বাঁচাতে। দুনিয়ার জীবনের যাবতীয় লোভ-লালসা আর হিংসা-পরশ্রীকাতরতার মতো অনেক কুপ্রবৃত্তিকে সংযত করতে। সব ধরনের অবাধ্যতা পরিহার করে এক আল্লাহর অনুগত এবং নির্দেশ মতো জীবন যাপন করতে।

হে আল্লাহ, আপনি আমাদের মৃত্যুর যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণের তাওফীক দিন। আমাদেরকে শামিল করুন আপনি মুত্তাকী বান্দাদের কাতারে। নসীব করুন ঈমানের সঙ্গে এবং শাহাদাতের মৃত্যু। আমীন।
আলী হাসান তৈয়ব
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

ঈর্ষা

সা’দ চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে দেখতে পেল মায়া ড্রয়িংরুমের জানালার সামনে উদাস ভঙ্গিতে বসে আছে- রাতের অন্ধকারের পটভূমিতে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় পরীর মত লাগছে ওকে। সোফায় বসে পা দু’টো একটা মোড়ার ওপর তুলে দেয়া, দু’বাহু পরস্পরকে জড়িয়ে মুকুটের মত ধারণ করে আছে ওর প্রিয় মুখটা, পাশে টেবিলের ওপর একটা বই খোলা অবস্থায় পড়ে আছে। বৌটাকে এভাবে একা বসে থাকতে দেখে দুনিয়াদারী কাজকর্ম সব ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে সা’দের। একটা মাত্র বৌ, তাও নতুন- কত, সবেমাত্র পনেরো বছর হোল, ওর তো ইচ্ছে মায়ার সাথে
অনন্তকাল কাটানোর- কিন্তু একসাথে থাকা হচ্ছে কই? কাজ থেকে অবসরই যে মিলেনা! সা’দের শব্দ পেয়ে হাসিমুখে উঠে আসে মায়া, ‘আসসালামু আলাইকুম!’
এ কি? ওর মুখে হাসি কিন্তু চোখের কোণে চিক চিক করছে দু’ফোঁটা অশ্রু। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে সা’দের। সে অস্থির হয়ে ওঠে, ‘মায়া, আমি কি তোমাকে কোনভাবে কষ্ট দিয়েছি?’
‘সে কি? হঠাৎ এ’কথা কেন?’, অবাক হয় মায়া।
‘তোমাকে কেউ কিছু বলেছে?’
‘কে আবার আমাকে কি বলবে?’
‘কোথাও কোন দুঃসংবাদ পেয়েছ?’
‘তুমি হঠাৎ এমন জেরা করা শুরু করলে কেন? কোন সমস্যা?’, কিছুই বুঝতে পারেনা মায়া।
‘তোমার চোখে জল কেন?’
‘কি!’, আশ্চর্য হয় মায়া, আঙ্গুল দিয়ে চোখের কোণ পরখ করে লজ্জা পেয়ে যায়, ‘ও কিছু না, তুমি খেতে এসো’।
সা’দের মনের ভেতর খচখচ করে। খেতে বসে বার বার মায়াকে বলে, ‘অ্যাই কি হয়েছে বলনা! তুমি কাঁদছিলে কেন?’
মায়াও ভীষণ লজ্জা পেয়ে বার বার বলে, ‘আমি কাঁদছিলাম না’।
সা’দ জানে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করতে মায়ার ভীষণ আপত্তি। সে সবসময় পরিবারের সবাইকে ছায়া দিয়ে, মায়া দিয়ে বেঁধে রাখতে চায়, কিন্তু নিজের সমস্যাগুলো কারো সামনে তুলে ধরতে চায়না, ওর সামনেও না। তাই তো এতবার করে জিজ্ঞেস করা।
খাওয়ার পর দু’জনে ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসে গল্প করার জন্য। এই সময়টুকু একান্তই ওদের নিজেদের। কোনদিন বাসায় মেহমান থাকলে কিংবা দাওয়াতে গেলে এই সময়টা মার যায়- খুব আফসোস হয় সা’দের। কিছুক্ষণ গল্প করল ওরা- সারাদিন কে কি করেছে, বাবামা কেমন আছেন, বাচ্চারা কি কি দুষ্টুমী করল, সা’দের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ওরা কিভাবে ঘুমিয়ে পড়ল ইত্যাদি। এত কথার ভিড়েও প্রশ্নটা আবার সা’দের মাথায় চেপে বসল, মায়ার চোখে জল কেন? ওকে সা’দ কখনো সাধারন মেয়েদের মত কাঁদতে দেখেনি, বরং সা’দ ভেঙ্গে পড়লে মায়াই সাহস আর সংকল্প দিয়ে ওকে টেনে তুলেছে বার বার। সে যে কাঁদতে পারে তাই তো সা’দ জানতোনা!
‘মায়া!’
‘হুঁ!’
‘তোমার চোখে পানি দেখলাম, ভাল লাগছেনা। বলবেনা কি হয়েছে?
‘আমি তো প্রায়ই চোখের পানি ফেলি, তুমিই দেখতে পাওনা। আজ একদিন দেখে ফেলেই অস্থির হয়ে গেলে?’ দুষ্টুমী করে মায়া।
সা’দের চোখে আতঙ্ক দেখে দুষ্টুমী উড়ে পালায় মায়ার। নাহ, এ’লোক দুষ্টুমীও বোঝেনা!
‘আচ্ছা, বলছি। হাসবেনা কিন্তু’।
সামনের দিকে ঝুঁকে আগ্রহ প্রকাশ করে সা’দ।
‘মুস’আব (রা)র জীবনী পড়ছিলাম। কেন যেন চোখে পানি চলে এলো’।
হাসি পায়না সা’দের, একটা সুক্ষ্ণ ঈর্ষাবোধ খোঁচা দেয় মনের ভেতর, ‘ও! সেই হ্যান্ডসাম সাহাবী?’
মায়া আবেগের সাথে কথা বলতে থাকে যেন শুনতে পায়নি, ‘তিনি সেই সাহাবী যিনি ইসলামের জন্য সকলপ্রকার প্রাচুর্য আরাম আয়েশ ত্যাগ করেন, মদীনায় রাসূল (সা)এর আগমনের পটভূমি রচনা করার দায়িত্ব পান, যিনি রাসূল (সা) কে রক্ষা করার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছান, যার জীবনের শেষমূহূর্তে বলা কথাগুলো আল্লাহ কুর’আনের অন্তর্ভুক্ত করে দেন, যার মৃত্যু রাসূল (সা)কে কাঁদায়।’
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মায়া, ‘আমার ভীষণ ঈর্ষা হচ্ছে ওনার জীবনী পড়ার পর থেকে’।
এবার সা’দের অবাক হবার পালা, ‘কেন? শ্রদ্ধা বোধ হতে পারে, মায়া লাগতে পারে, কিন্তু ঈর্ষা কেন বুঝলাম না’।
‘আচ্ছা শোন। এটা একটা কথা হোল, আল্লাহ একটা মানুষকে একই সাথে জ্ঞান, বুদ্ধি, মেধা, ব্যাবহার, সৌন্দর্য, প্রাচুর্য সবকিছু দিয়ে দিলেন; আর উনিও সুন্দর সবকিছু তাঁর রাব্বের জন্য উৎসর্গ করে দিলেন! এই কম্পিটিশনে আমাদের টেকার কোন সম্ভাবনা আছে?’
সা’দ ভেবে দেখল, ‘হুমম। প্রথমত এই জিনিসগুলোর মধ্যে সবগুলো আমাদের নেই বা ঐ পরিমাণে নেই। দ্বিতীয়ত, যতটুকু আছে তার সবটুকুই আমরা খরচ করছি পৃথিবীর আরাম আয়েশের জন্য। এভাবে ভেবে দেখা হয়নি’।
‘তারপর দেখ, তিনি একটি নতুন জায়গায় অপরিচিত লোকজনের মাঝে ইসলাম প্রচার করার কাজ নিয়ে চলে যান এবং অল্প সময়ে পরিস্থিতি অনুকুলে নিয়ে আসেন। আমরা কি এমনকি আমাদের সন্তানদের ইসলামে প্রবেশ করার পেছনে এত সাধনা করি?’
‘তাই তো? সন্তানদের খাওয়াপরা, পড়াশোনা, ভবিষ্যত চিন্তা নিয়ে আমাদের ভাবনার অন্ত নেই কিন্তু তাদের আখিরাত নিয়ে তো আমাদের ভাবার সময় হয়না!’
‘তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে পলায়নপর যোদ্ধাদের বার বার আহ্বান করছিলেন, ‘আর মুহাম্মদ একজন রাসূল বৈ তো নয়! তাঁর পূর্বেও বহু রসূল অতিবাহিত হয়েছেন। তাহলে কি তিনি যদি মৃত্যুবরণ করেন অথবা নিহত হন, তবে তোমরা পশ্চাদাপসরণ করবে? বস্তুতঃ কেউ যদি পশ্চাদাপসরণ করে, তবে তাতে আল্লাহর কিছুই ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে না। আর যারা কৃতজ্ঞ, আল্লাহ তাদের পুরস্কৃত করবেন’। ভাব তো, বিশৃংখল পরিবেশ, কেউ কেউ ধারণা করছে রাসূল (সা) হয়ত আর নেই তাহলে যুদ্ধ করে কি হবে, সব এলোমেলো, এর ভেতর একজন দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছে আমরা আল্লাহর জন্য যুদ্ধ করি, রাসূল (সা) থাকুন বা না থাকুন ইসলামকে টিকিয়ে রাখা আমাদের দায়িত্ব! আর তারপর তিনি রাসূল (সা)কে রক্ষা করতে করতে নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিলেন। অতঃপর আল্লাহ তাঁর কথাগুলো তাঁর মহান বানীর অংশ হিসেবে গ্রহন করে নিলেন। এর সাথে তুলনা করলে আমরা কোথায় স্থান পাই বল তো?’
‘আসলেই তো! আমরা তো নিজেদের কোনকিছুতে এক চুলও ছাড় দিতে রাজী না আল্লাহর দ্বীনের জন্য। আগে আমাদের প্রয়োজন, আরাম আয়েশ ঠিক থাকা চাই, তারপর সুযোগ থাকলে দ্বীনের কাজ। মনে হয় যেন আমাদের জন্য দুনিয়াটা ফরজ আর আল্লাহর সন্তুষ্টি হোল একটা শৌখিন ব্যাপার, সময় থাকলে করা যাবে।’
‘হুমম, তাই ঈর্ষায় চোখে পানি চলে এসেছিল। তুমি তো জানো আমি ভীষণ কম্পিটিটিভ, হারতে পছন্দ করিনা মোটেই, তোমার কাছে ছাড়া। কিন্তু কিয়ামতের মাঠে এঁদের ডিঙ্গিয়ে যাবার উপায় তো নেইই, বরং এঁরা যে স্ট্যান্ডার্ড সেট করেছেন তারপর বিচারে ধরা খাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এসব ভাবলেই কেন যেন চোখে পানি চলে আসে’, দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মায়া।
সা’দকে ভাবনায় ডুবিয়ে দিয়ে বাচ্চাদের গায়ে কাঁথা ঠিক আছে কিনা চেক করতে চলে যায় মায়া।
মায়া অন্যান্য মেয়েদের মত নয়। সা’দের চোখ দিয়ে না দেখলে সে সুন্দরী নয়। সবসময় গুছিয়ে থাকলেও স্বামীর জন্য সাজগোজ করা ছাড়া সে হালফ্যাশনের কোন তোয়াক্কা করেনা। ওর রান্না কোনক্রমে খাওয়া যায় যদিও সা’দের মুখে ওটা অমৃত মনে হয়, কোন শৌখিন রান্নাবান্না করার চেয়ে সে পড়তেই ভালবাসে বেশি। তবু কেন যে বৌটাকে এত ভাল লাগে সা’দের! এজন্যই কি যে সে প্রতিদিন ভোরে সা’দকে কপালে টিপ দিয়ে প্রভুর সান্নিধ্যে যাবার জন্য আহ্বান করে? নাকি এজন্য যে সে প্রতিদিন সৃষ্টিকর্তার বানী থেকে কিছু অংশ নিজে পড়ে, তারপর বাসার সবাইকে শোনায়? এজন্য যে সে সা’দের বাবামায়ের প্রতিটি প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রাখে, তার সন্তানদের গড়ে তোলার ব্যাপারে যত্নশীল বলেই সা’দ নিশ্চিন্তে এত রাত পর্যন্ত বাইরে কাজ করতে পারে? নাকি এজন্য যে মায়া প্রতিদিন ওর আখিরাতের মাপকাঠিটাকে একটু উঁচু করে দেয় যেটা অর্জন করার জন্য ওকে আরেকটু বেশি মনোযোগী হতে হয়, আরেকটু বেশি সচেষ্ট হতে হয়, গতকাল সে যেখানে অবস্থান করছিল তার চেয়ে আরেকটু সামনে এগিয়ে যেতে হয়? এই তো সেই সাথী যার সাথে একটি জীবন কাটালে তার যথাযথ মূল্যায়ন হয়না, যার সাথে থাকার জন্য প্রয়োজন অনন্তকাল!
- রেহনুমা বিনত আনিস